মানব সভ্যতার উন্নতির সাথে প্রতারণার প্রকৃতি ও ধরন পরিবর্তন হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রতারণার অন্যতম মাধ্যম হলো ফেসবুক। অপরাধীরা ফেসবুক ব্যবহার করে বিভিন্ন উপায়ে প্রতারণার করে থাকে। বাংলাদেশেও এই ধরণের অপরাধ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতারণা থেকে রক্ষা পাবার প্রথম পদক্ষেপ হলো নিজে সচেতন হওয়া এবং পাশাপাশি অন্যকে সচেতন করা। আপনি তখন সচেতন হতে পারবেন যখন জানবেন অপরাধীরা কিভাবে মানুষের সাথে প্রতারণা করে থাকে। আমি পর্যায়ক্রমে আপনাদেরকে বিভিন্ন ধরনের ফাঁদের সাথে পরিচয় করে দেওয়ার চেষ্টা করব। আসুন জানার চেষ্টা করি।

ফাঁদ -০১

আমাদের আজকের ফাঁদ হলো “অতি লোভে তাঁতি নষ্ট” অথবা “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু”। একটু অবাক হচ্ছেন, তাইনা। ধৈর্য ধরে পড়তে থাকুন সহজেই বিষয়টি বুঝতে পারবেন।  

ঘটনা –

মন্টু (ছদ্মনাম) নামের এক ভদ্রলোক যিনি ঢাকায় থাকেন এবং ব্যবসা করেন। তিনি অনেকের মতই ফেসবুক ব্যবহার করে থাকে। হঠাৎ একদিন তার মেসেঞ্জারে একটি মেসেজ আসলো। ম্যাসেজটি হলো এরকম – একজন মার্কিন সৈনিক কোনো একটি দেশে কর্তব্যরত অবস্থায় কয়েক মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করে। তার ইচ্ছা উক্ত উদ্ধারকৃত ডলারগুলো বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাঠাতে চায় যাতে করে দরিদ্র মানুষের উপকারে আসে। এইজন্য সে মন্টু সাহেবকে নির্বাচন করেছে। তাকে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার প্রদান করবেন যাতে করে সে তার দেশে বিভিন্ন দরিদ্র লোকদের কে সাহায্য করতে পারেন। মন্টু সাহেব এই কাজ করার জন্য ৪০% কমিশন হিসাবে পাবেন। মন্টু সাহেবকে এই বিষয়টি প্রস্তাব করা হলে, মন্টু সাহেব প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে সে রাজি হয় এবং উক্ত মার্কিন ব্যক্তির নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এখানে বলে রাখি প্রথমে তারা ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করলেও পরবর্তী যোগাযোগ তারা ইমেইলের মাধ্যমে করেছিল। মন্টু সাহেব কে বলা হয় যেহেতু টাকার পরিমাণ অনেক বেশি সেহেতু বিষয়টি কোন ভাবে অন্যের সাথে শেয়ার না করতে। তাকে আরও বলা হয় বাংলাদেশের একজন ডিপ্লোম্যাট এজেন্ট তাকে ফোন দিবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে।  কথামত কামরান (ছদ্মনাম) নামের এক ভদ্রলোক মন্টু সাহেব কে ফোন দেন এবং জানান টাকার পার্সেলটি বাংলাদেশে এসেছে। সেটি স্ক্যান করার জন্য তাকে ১৩০০ ডলার প্রদান করতে হবে। মন্টু সাহেব যথারীতি কামরানের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ব্যাংকে ১৩০০ ডলার জমা করেন। যেহেতু মন্টু সাহেব প্রথম ফাঁদে পা দিয়ে যথারীতি টাকা জমা দিয়েছেন সেহেতু কামরান দ্বিতীয় ফাঁদ পাতেন।  এবার কামরান মন্টু সাহেবকে বলেন পার্সেলটি ছাড়ানোর জন্য তাকে আরও ১৬০০ ডলার প্রদান করতে হবে এবং পাশাপাশি এ কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য আলাদাভাবে কামরানের ব্যক্তিগত একাউন্টে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত মন্টু সাহেব লোভে পড়ে তিনি ওই টাকাও নির্দিষ্ট ব্যাংকে নির্দিষ্ট দিনে জমা করেন।  কামরান যখন দেখল টাকা চাইলেই পাওয়া যাচ্ছে সেহেতু সে তৃতীয় ফাঁদ পাতার চেষ্টা করে। সেটা হল মন্টু সাহেবকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে আরো টাকা হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করা । কামরান যখন মন্টু সাহেবকে ভয়ভীতি দেখানো শুরু করে এবং তার সাথে সরাসরি দেখা করতে বলে তখন মন্টু সাহেবের বিষয়টি বোধগম্য হয় যে তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মন্টু সাহেব আইনের শরণাপন্ন হন । তিনি তার এলাকার থানায় যান এবং জিডি করেন ।  পরবর্তীতে তিনি বিচার পাবার আশায় সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। বর্তমানে মামলাটি চলমান এবং আসামি পলাতক। 

প্রাসঙ্গিক আলোচনা-

অনেকে ঘটনাটি পড়ে হাসতে পারেন এবং মনে করতে পারেন এই রকম বোকা লোক  কি এখনও দুনিয়াতে আছে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মন্টু সাহেব একজন সাধারণ ব্যক্তি কিন্তু আদালতে এই রকম অনেক মামলা চলমান আছে যারা উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত তারাও এ ধরণের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন। প্রতারক এমন ভাবে আপনার সাথে কথা বলবে এবং আপনাকে বিভিন্ন প্রমাণ দিয়ে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করবে যাতে করে আপনি তার প্রতারণার বিষয়টি ধরতে না পারেন।   

প্রতারণার কৌশল-

প্রতারক মূলত প্রতারণার জন্য একটি বিশ্বাস মুলক গল্প উপস্থাপন করে। গল্প গুলো এরকম হয় কোন এক ভদ্রমহিলা তার একটি শিশু সন্তান আছে এবং তার হাজবেন্ড রোড এক্সিডেন্ট এ মারা গেছে তার একজন সঙ্গী লাগবে। অথবা তার কাছে অনেক টাকা আছে সে চায় ব্যবসা করতে অথবা সে যুদ্ধের আক্রান্ত দেশে শান্তি মিশনে আছেন কিছুদিনের ভিতর সে চাকরি থেকে অবসরে যাবেন এ কারণে সে একজন বিশ্বস্ত লোক খুঁজছেন যাতে তার দেশে ব্যবসা করতে পারেন। এরকম অনেক গল্প আছে যা বলে শেষ করা যাবে না।

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতারক মেয়ে সেজে এ ধরনের মেসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে থাকে। প্রতারক যোগাযোগের একপর্যায়ে আর্মি ড্রেস পরা ছবি দিবে, অথবা অনেক ডলারের সামনে বসে ছবি দিবে, অথবা একটি শিশু সন্তান নিয়ে সুন্দর ছবি দিবে যাতে করে আপনি তার প্রতারণার ফাঁদে পা দেন।  এইসব প্রতারণার ফাঁদে পা দিবে মূলত তারাই যারা লোভী এজন্যই আমি প্রথমে বলেছিলাম লোভে পাপ পাপে মৃত্যু অথবা অতি লোভে তাঁতি নষ্ট।  

আজকে এই পর্যন্তই ।  আমরা পরবর্তী পর্বে আরেকটি ফাঁদ নিয়ে আলোচনা করব। 

কে, এম, খায়রুল হাসান আরিফ

অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট

এবং

কনসালটেন্ট ও ফাউন্ডার

এডভোকভাইস

(সাইবার ক্রাইম | টেকনোলজি | ডাটা প্রটেকশন এন্ড প্রাইভেসি | মিডিয়া | ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি | ইমিগ্রেশন ও ভিসা | ভ্যাট ও ট্যাক্স | যে কোনো আইনগত বিষয়ে পরামর্শের জন্য ইমেইল করুন – [email protected] or [email protected] )

Design Credit: canva.com

#প্রতারণা #সাইবারট্রাইব্যুনাল #সাইবারক্রাইম #ক্রাইম #অনলাইনক্রাইম #অনলাইনপ্রতারণা #সাইবারঅপরাধী #সাইবারমামলা #সাইবার #cyber #cybercrime #cyberlaw #cyberawareness #scammers #scam #facebook #facebookscams #messenger #cybercrimeawareness